Blog, Finance, Islamic

ইসলামিক ফাইন্যান্স; অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উত্তরণের অন্যতম উপায়

islamic-finance-economy

অর্থনৈতিক মন্দা একটি বিস্তৃত ইস্যু ; মৌলিকভাবে এর মানে ফাইন্যান্সিয়াল মার্কেটের দুর্দশাকে বোঝায় যা কিনা ব্যবসার পাশাপাশি পরিবারগুলোতেও ব্যাঘাত ঘটায়। আর্থিক সংকটের প্রভাব বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গিতে জাতীয় সীমানার বাইরেও যেতে পারে, যা আমরা ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় দেখেছি।অর্থনৈতিক সংকটের ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সম্পদের মূল্য ব্যাপকভাবে হ্রাস পেতে পারে, ইনভেস্টররা তাদের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে হারাতে পারে, স্টক মার্কেটে ধ্বস নামতে পারে, ঋণখেলাপির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পারে, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে পারে।

২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের ক্রিটিকাল অ্যানালাইসিস থেকে আমরা কিছু নির্দিষ্ট কারণ দেখতে পাই যার ফলে সমস্যাটি দিন দিন আরো বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যা প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Conventional Finance) থেকে তৈরী হয়েছিল। তবুও একটি ভালো অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করার জন্য আমাদের কাছে এখনো কোনো সুস্পষ্ট সমাধান নেই। অন্যদিকে, ইসলামিক ফাইন্যান্সের দৃষ্টিকোণে আমাদের সামনে আসা এই সমস্যাগুলো সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার আশা দেখায়।

আর্টিকেলের উদ্দেশ্য

সেক্যুলার দৃষ্টিভঙ্গিতে, ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের উৎস হিসেবে অনিয়ন্ত্রিত ঋণপ্রদান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে অনৈতিক প্রতিযোগিতা, উচ্চ তারল্য, স্বচ্ছতার অভাব, ডেরিভেটিভ এবং অন্যান্য আর্থিক ইঞ্জিনিয়ারিং মডেলের ব্যবহারকে সমস্যার কারণ হিসেবে ভাবা হয়। এই কারণগুলো ব্যবসায়িক পরিবেশকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নিয়ে যায়। সুপারভাইজারি সংস্থার ফ্লেক্সিবিলিটিও এর অন্যতম কারণ হিসেবে ধারনা করা হয়। এর কারণে প্রতিষ্ঠানগুলি সঠিকভাবে ঝুঁকি বিবেচনা না করেই অস্পষ্ট লেনদেনে জড়িয়ে পড়েছিল।

সেই অর্থনৈতিক সংকটের সময় এটা স্পষ্ট ছিল যে, ইসলামিক ফাইনান্সিয়াল সিস্টেমের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলি খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়নি। যদিও ইসলামিক ফাইন্যান্স বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে বিকশিত হচ্ছে এবং এটি ইঙ্গিত করে আর্থিক ব্যবস্থার পাশাপাশি অর্থনীতির সাস্টেইনেবিলিটি নিশ্চিত করার জন্য ইসলামিক ফাইন্যান্স হতে পারে একটি স্থায়ী ব্যবস্থা। শরিয়াহ মেনে চলা বিভিন্ন প্রোডাক্ট রয়েছে যা প্রচলিত ব্যাংকিংয়ের ভালো বিকল্প হতে পারে। যদিও স্টেকহোল্ডাররা মনে করেন যে এগুলো প্রচলিত ব্যাংকিং প্রোডাক্টের বিপরীতে পর্যাপ্ত নয়।

ইসলামিক ফাইন্যান্সের ক্ষেত্রে বিভিন্ন রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট কাজ চলমান রয়েছে যাতে আরো শরিয়াহ সম্মত প্রোডাক্ট খুঁজে বের করার পাশাপাশি মার্কেটে এওয়ারনেস তৈরীর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। এটাও স্পষ্ট যে ইসলামিক ফাইন্যান্স প্রচলিত ব্যবস্থার তুলনায় মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে।

সেক্যুলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বনাম ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা

অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা প্রত্যেক মানুষের কাম্য। আর্থিক স্বচ্ছলতা বা মানুষের জীবনযাত্রার মান নিশ্চিত করতে টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অপরিহার্য। সেক্যুলার অর্থনীতি অনুসারে, সম্পদের ঘাটতি আছে ; তবে রিসোর্সের সর্বোত্তম ব্যবহার, সাপ্লাই এবং ডিমান্ড নিশ্চিত করে অর্থনীতি পারফর্ম করছে। যদিও ইসলামী অর্থনীতি এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দ্বিমত পোষণ করে, কিন্তু সেক্যুলার অর্থনীতিও সম্পদের সঠিক বন্টনের গুরুত্বকে স্বীকার করে। অন্যথায়, কিছু মানুষ সম্পদ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত হতে পারে আর কেউ তাদের প্রয়োজনের চাইতেও বেশি পেতে পারে। ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার সময়েও বিশ্বায়নের ধারণা নিরর্থক প্রমাণিত হয়েছিল। তাই সেই আর্থিক বিপর্যয় আমাদেরকে প্রচলিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বিকল্প ভাবতে প্রভাবিত করে ।

অন্যদিকে, ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিশ্বাস করে যে আল্লাহ পৃথিবীর সমস্ত সম্পদের মালিক এবং আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনা অনুযায়ী তার দায়িত্ব পালন, ভালো কাজে উৎসাহিত করা এবং খারাপ কাজকে নিরুৎসাহিত করার জন্য মানুষকে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে। শরিয়াহর উৎস হল কুরআন (আল্লাহর বাণী যা জিবরাঈলের মাধ্যমে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রেরিত হয়েছিল), সুন্নাহ (রাসূলুল্লাহ (সা।)-এর সহীহ হাদিস), ইজমা (মুসলিম আলেমদের ঐকমত্য) এবং কিয়াস (কুরআন, হাদিস, ইজমা থেকে সুস্পষ্ট কোনো দলিল পাওয়া না গেলে কুরআন এবং হাদিসের নির্দেশনা অনুযায়ী অনুমানের প্রক্রিয়া)।

শরিয়াহ অনুসারে, আল্লাহ পৃথিবীতে পাঠানো সমস্ত জীবের জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত সম্পদের ব্যবস্থা করেন। সুতরাং, সম্পদের ঘাটতি নেই বরং সম্পদের অনুপযুক্ত বন্টনই কিছু লোককে অধিক সম্পদের মালিক বানায় আর অন্যদেরকে চরম দারিদ্রতার সীমায় নিয়ে যায়। সেক্যুলার অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অন্যদের স্বার্থকে বিবেচনা না করে ব্যক্তিগত সুখ-সমৃদ্ধি এবং লাভ বা মুনাফা বৃদ্ধির উপর ফোকাস করে যেখানে ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রত্যেককে শরিয়াহ নির্দেশ অনুসারে তার কর্তব্য পালনে উৎসাহিত করে, যা কি না বেশ কিছু বিষয় নিষিদ্ধ করে (লেখার পরবর্তী অংশে এই ব্যাপারে আলোচনা করা হয়েছে), জবাবদিহিতা এবং সমাজের সাম্যাবস্থা বজায় রাখে।

শরিয়াহ অনুসারে, সার্বজনীন উদ্দেশ্য হলো অত্যাবশ্যক, প্রয়োজনীয়তা এবং বিলাসিতা। একজন ব্যক্তি একবার তার জীবনের আবশ্যকীয় অংশ অর্জন করে ফেললে তারপর সে প্রয়োজনীয়তা এবং শেষে বিলাসিতার দিকে অগ্রসর হয়। শরিয়াহ এটি বাধ্যতামূলক করে যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্পদ অর্জনের পরে একজন ব্যক্তিকে সম্পদের ২.৫% সমাজের দরিদ্র ও বঞ্চিত ব্যক্তিদের দান করতে হবে, যাকে যাকাত বলা হয়। এছাড়াও আরও কিছু মডেল যেমনঃ ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সাদাকাহ, জিযিয়া, ওয়াকফ রয়েছে যা সমাজের মধ্যে সঠিক সম্পদ বণ্টন নিশ্চিত করে।

ইসলামের প্রতিষ্ঠিত আইন

প্রথমত, ইসলামিক ফাইন্যান্সের বিষয়গুলো যেমনঃ চুক্তি শুধুমাত্র শব্দ এবং ফর্ম নয় বরং উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। লেনদেন, চুক্তি বা চুক্তির উপাদান অন্তর্নিহিত বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়।

দ্বিতীয়ত, শরিয়াহ সব পরিস্থিতিতেই সুবিধা দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যখন চুক্তি অনুযায়ী একটি ব্যাপার নিষিদ্ধ কিন্তু তা যদি আবশ্যক হয়ে যায় (যেমনঃ জীবন বাঁচানো) তখন সেই শর্তে তা জায়েজ হবে। আবার অপরিহার্যতা পূরণ হয়ে গেলে তা আগের মত নিষেধাজ্ঞা হিসেবেই বহাল থাকবে।

তৃতীয়ত, শরিয়াহ ম্যাক্সিম অনুসারে হারাম অবশ্যই দূর করতে হবে। এই আইনের উপর ভিত্তি করে ইসলামিক ফাইন্যান্স কখনোই হারাম (নিষিদ্ধ) পণ্য বা সার্ভিসে বিনিয়োগ করে না যেমনঃ শুকুরের মাংস, অ্যালকোহল,পর্নোগ্রাফি ইত্যাদি। কারণ এই জিনিসগুলি সমাজের পাশাপাশি ব্যক্তিগত জীবনেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

চতুর্থ, শরিয়াহ নিশ্চিত করে যে আশ্বাস কখনোই সন্দেহের বশে বাতিল করা হয় না। এই ধারণার অধীনে এটি অনুমান করা হয় যে একজন মানুষ জন্ম থেকেই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত। এছাড়াও, যতক্ষণ পর্যন্ত না অসঙ্গতি প্রমাণ হয় ততক্ষণ পর্যন্ত বিষয়টি মূলরূপে বিবেচনা করা উচিত। আরো সহজ বাংলায় বললে, একজন ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ।

পঞ্চম, প্রথাকে বিচারের ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ম্যাক্সিমের অর্থ হল প্রথা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত যে কোনও বিষয় গঠনমূলক চুক্তি হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ব্যবসায়ীদের দ্বারা স্বীকৃত যেকোন সাধারণ ব্যবসায়িক চর্চাকে চুক্তিভিত্তিক বাধ্যবাধকতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে।

ইসলামিক ফাইন্যান্সের সর্বোচ্চ বিষয়গুলো যেকোনো ব্যবসায়িক পরিবেশের অধীনে কোনো চুক্তি, লেনদেন বা চুক্তির বৈধতা এবং যৌক্তিকতা নিশ্চিত করে।

ইসলামিক ফাইন্যান্সে প্রধান নিষেধাজ্ঞা

শরিয়াহ অনুসারে, ইসলামিক ফাইন্যান্স ব্যবসার ক্ষেত্রে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিকে নিষিদ্ধ করে:

রিবা (সুদ)
ঘারার (অস্পষ্টতা)
মায়সির (জুয়া)
তালা’উব (কারসাজি)
ইহতিকার (অসৎ উদ্দেশ্যে মজুদ করা বাণিজ্য পণ্য)
নাজ (কৃত্রিম মূল্য বৃদ্ধি)
তাদলিস (প্রতারণা)

বেশিরভাগ সময় বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো এই কারণগুলোর কারণেই ব্যর্থ হয়, যা ইসলামি অর্থনীতিতে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। সুতরাং, ইসলামি অর্থনীতি মেনে চলার ফলে একটি স্বচ্ছ এবং দীর্ঘস্থায়ী ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে যা টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মূল কারণ।